ঘাসফড়িং এর পৌষ্টিকতন্ত্র (Digestive System of Grasshopper): ঘাসফড়িং-এর খাদ্যাভ্যাসের সাথে পৌষ্টিকতন্ত্র অভিযোজিত এবং প্রধান দুটি অংশ নিয়ে গঠিত যথা-পৌষ্টিকনালি ও পৌষ্টিকগ্রন্থি।
পৌষ্টিকনালি (Alimentary Canal) : ঘাসফড়িং-এর পৌষ্টিকনালি সরল প্রকৃতির এবং মুখছিদ্র থেকে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত দেহের মধ্যরেখা বরাবর সোজা নালি হিসেবে অবস্থিত। বর্ণনার সুবিধার জন্য পৌষ্টিকনালিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে : স্টোমোডিয়াম, মেসেন্টেরন ও প্রোক্টোডিয়াম।
১. স্টোমোডিয়াম বা অগ্র-পৌষ্টিকনালি (Stomodaeum or Foregut) : এটি মুখছিদ্র থেকে গিজার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত পৌষ্টিকনালির প্রথম অংশ। ভূণীয় এক্টোডার্ম থেকে উদ্ভূত এ অংশটির অন্তঃপ্রাচীর কাইটিন (chitin) নির্মিত শক্ত আবরণে আবৃত। এটি প্রধানত নিচে উল্লেখিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত।
ক. মুখছিদ্র (Mouth) : এটি প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠ (preoral cavity) বা সিবেরিয়াম (cibarium) নামক প্রকোষ্ঠের গোড়ায় অবস্থিত ছিদ্রবিশেষ প্রকোষ্ঠটি মুখোপাঙ্গে বেষ্টিত থাকে ৷
কাজ : সিবেরিয়ামে খাদ্যবস্তু গৃহীত হয় এবং মুখছিদ্র পথে খাদ্য দেহে প্রবেশ করে ।
খ. গলবিল (Pharynx) : মুখছিদ্রটি ছোট নলাকার ও পেশিবহুল গলবিলে উন্মুক্ত।
কাজ : এর মাধ্যমে খাদ্যবস্তু গ্রাসনালিতে প্রবেশ করে ।
গ. গ্রাসনালি (Oesophagus) : এটি গলবিলের পিছনে সরু, সোজা, নলাকার পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট নালি।
কাজ : খাদ্যবস্তু মুখ থেকে বহন করে ক্রপে পৌছে দেয়।
ঘ. ক্রপ : গ্রাসনালি স্ফীত হয়ে মোচাকৃতি থলির মতো ও পাতলা প্রাচীরযুক্ত ক্রপ গঠন করে।
কাজ : খাদ্যবস্তু কিছু সময়ের জন্য এখানে জমা থাকে। ক্রপের সংকোচন প্রসারণে খাদ্য কিছুটা চূর্ণ হয় এবং লালার এনজাইম পরিপাকের সূত্রপাত ঘটায়।
ঙ. গিজার্ড বা প্রোভেন্ট্ৰিকুলাস (Gizzard or Proventriculus) : এটি গ্রুপের পরবর্তী ত্রিকোণাকার বেশ শক্ত, পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট এবং অন্তঃপ্রাচীরের কাইটিনময় ছয়টি দাঁত ও ছয়টি অনুলম্ব ভাঁজ নিয়ে গঠিত অংশ। দাঁতের পিছনে চুল ও ছয়টি প্যাড থাকে। এর পরের অংশে থাকে পিছনে প্রসারিত কপাটিকা ।
কাজ : গিজার্ডের দৃঢ় সংকোচন-প্রসারণ খাদ্যকে চূর্ণ করে; প্যাডের চুলগুলো খাদ্যকণাকে মেসেন্টেরনে প্রবেশের সময় ছাঁকনির কাজ করে; এবং কপাটিকাগুলো খাদ্যকে বিপরীত দিকে আসতে বাধা দেয়।
২. মেসেন্টেরন বা মধ্য-পৌষ্টিকনালি বা পাকস্থলি (Mesenteron on Midgut) : গিজার্ডের পর থেকে শুরু করে উদরের মধ্যাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট অংশটি মেসেন্টেরন । এটি ভ্রূনীয় এন্ডোডার্ম স্তর থেকে সৃষ্টি হয় এবং এর অন্তঃপ্রাচীর কিউটিকলের পরিবর্তে পেরিট্রফিক পর্দা (peritrophic mentirane) নামক বৈষম্যভেদ্য পর্দা দিয়ে আবৃত। মেসেন্টেরনের অগ্র ও পশ্চাৎ প্রান্তে পেশির বলয় বা স্ফিংক্টার (sphincter) থাকে। মেসেন্টেরন এবং স্টোমোডিয়ামের সংযোগস্থলে ৬ জোড়া ফাঁপা, লম্বা মোচাকার থলি থাকে। সেগুলো হচ্ছে গ্যাস্ট্রিক সিকা (gastric caeca) বা হেপাটিক সিকা (hepatic caeca)। প্রতিজোড়া হেপাটিক সিকার একটি সামনের দিকে অন্যটি পিছন দিকে প্রসারিত। মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীর স্তম্ভাকার অস্তঃত্বকীয় কোষে (columnar endodermal cells) গঠিত এবং এটি ভাজ হয়ে অসংখ্য ভিলাই (villi) গঠন করে। মেসেন্টেরনের শেষ অংশে অসংখ্য সূক্ষ্ম চুলের মতো এবং হলদে বর্ণের অঙ্গাণু থাকে। এগুলো ম্যালপিজিয়ান নালিকা (malpighian tubules) যা মূলত রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
কাজ : মেসেন্টেরনের গহ্বর (lumen)-এ খাদ্যবস্তুর পরিপাক ঘটে এবং এর প্রাচীরে অবস্থিত ভিলাই খাদ্যরস শোষণ করে।
৩. প্রোক্টোডিয়াম পশ্চাৎ-পৌষ্টিকনালি (Proctodaeum or Hindgut) :
এটি পৌষ্টিকনালির শেষ অংশ যা ভূণীয় এক্টোডার্ম থেকে উদ্ভূত এবং অন্তঃপ্রাচীর কিউটিকল দিয়ে আবৃত। নিচে বর্ণিত ৪টি অংশ নিয়ে প্রোক্টোডিয়াম গঠিত।
ক. ইলিয়াম (Iluem) : এটি প্যাচবিহীন, চওড়া নলাকার প্রথম অংশ।
কাজ : এর প্রাচীরের মাধ্যমে পরিপাককৃত খাদ্যরস শোষিত হয় ।
খ. কোলন (Colon) : এটি ইলিয়ামের পিছনে অবস্থিত সরু নলাকার অংশ।
কাজ : পাচিত খাদ্যবস্তুর বাকি অংশ পানিসহ শোষিত হয়।
গ. রেকটাম বা মলাশয় (Rectum) : এটি পৌষ্টিকনালির সর্বশেষ স্ফীত ও পুরু প্রাচীরযুক্ত অংশ। এর অন্তঃস্থ প্রাচীরে ছয়টি রেকটাল প্যাপিলা (rectal papilla; বহুবচনে-papillae) নামক অনুলম্ব ভাঁজ রয়েছে।
কাজ : মল থেকে অতিরিক্ত পানি, খনিজ লবণ, অ্যামিনো এসিড শোষণ করা এবং অপাচ্য অংশ সাময়িক জমা রাখা এর কাজ।
ঘ. পায়ুছিদ্র (Anus) : এটি মলাশয়ের শেষপ্রান্তে অবস্থিত ছিদ্রপথ। এটি দশম দেহখণ্ডকের অঙ্কীয়দেশে উন্মুক্ত।
কাজ : অপাচ্য অংশ মল (faeces) হিসেবে দেহ থেকে অপসারণ করে।
পৌষ্টিকগ্রন্থি (Digestive Glands):
ঘাসফড়িং-এর লালাগ্রন্থি, মেসেন্টেরনের অন্তঃআবরণ এবং হেপাটিক সিকা পৌষ্টিকগ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। নিচে এসব অংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
১. লালাগ্রন্থি (Salivary glands) : এটি ঘাসফড়িং-এর প্রধান পৌষ্টিকগ্রন্থি। ত্রুপের নিচে ক্ষুদ্র, শাখাপ্রশাখা-যুক্ত একজোড়া লালাগ্রন্থি অবস্থিত। লালাগ্রন্থির নালি ল্যাবিয়ামের গোড়ায় গলবিলে উন্মুক্ত হয়।
কাজ : লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস (saliva) খাদ্য গলাধঃকরণ ও চর্বণে সাহায্য করে। কিছু শর্করা জাতীয় খাদ্য পরিপাকেও এটি ভূমিকা পালন করে।
২. মেসেন্টেরন বা মধ্য-পৌষ্টিকনালির অন্তঃআবরণ : মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীরে বেশ কিছু ক্ষরণকারী কোষ (secretary cells) আছে যা থেকে পাচকরস ক্ষরিত হয়।
কাজ : ক্ষরিত পাচকরস খাদ্য পরিপাকে অংশ নেয়।
৩. হেপাটিক সিকা (Hepatic caeca) : অগ্র ও মধ্য-পৌষ্টিকনালির সংযোগস্থলে অবস্থিত কোণ (cone) আকৃতির ছয়জোড়া লম্বা স্বচ্ছ নালিকাকে হেপাটিক বা গ্যাস্ট্রিক সিকা বলে।
কাজ : হেপাটিক সিকার অন্তঃপ্রাচীরে অবস্থিত ক্ষরণকারী কোষ থেকে পাচকরস ক্ষরিত হয়ে খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।
খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক (Feeding & Digestion):
খাদ্য : ঘাসফড়িং সম্পূর্ণ তৃণভোজী বা শাকাশী (herbivorous) প্রাণী। ঘাস, শস্যদানা, লতা-পাতা খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। এদের খাবারে শর্করা, আমিষ ও স্নেহজাতীয় সমস্ত উপাদানই থাকে।
খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতি : ঘাসফড়িংয়ের যে মুখোপাঙ্গ তা শুধু চিবানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই এদের খাদ্য গ্রহণকে চর্বণ (chewing) এবং মুখোপাঙ্গকে চর্বণ-উপযোগী বা ম্যান্ডিবুলেট (chewing or mandibulate) মুখোপাঙ্গ বলে। ঘাসফড়িং প্রথমে ম্যাক্সিলারি ও ল্যাবিয়াল পাল্পের সাহায্যে খাদ্য নির্বাচন করে। অগ্রপদ, ল্যাব্রোম এবং ল্যাবিয়াম খাদ্যবস্তু আটকে ধরে। ম্যান্ডিবল ও ম্যাক্সিলি খাদ্যবস্তুর ক্ষুদ্র অংশ কেটে চোষণ করে।
পরিপাক : খাদ্য প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠে পৌঁছার পরই লালাগ্রন্থি নিঃসত লালারস-এর সাথে মিশিতে হয়। লালারসে অ্যামাইলেজ, কাইটিনেজ ও সেলুলেজ এনজাইম থাকে যা বিভিন্ন শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে। খাদ্যবস্তু প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠ থেকে ক্রপে পৌছায়, এখান থেকে গিজার্ডে প্রেরিত হয়। আংশিক পরিপাককৃত খাদ্য গিজার্ডে প্রবেশ করলে কাইটিনময় দাঁতে পিষ্ট হয়ে অতি সূক্ষ্ম কণাসমৃদ্ধ পেস্ট (paste)-এ পরিণত হয়। এগুলো গিজার্ডে অবস্থিত সূক্ষ্ণ রোমে পরিস্রত হয়ে মেসেন্টেরনে প্রবেশ করে । মেসেন্টেরনের অন্তঃর্গাত্র এবং হেপাটিক সিকা ক্ষরণ ও শোষণতলরূপে কাজ করে। মেসেন্টেরনে মলটেজ, ট্রিপটেজ, অ্যামাইলেজ, ইনভার্টেজ, লাইপেজ প্রভৃতি এনজাইমের উপস্থিতিতে খাদ্যবস্তু সরল, তরল খাদ্যরসে পরিণত হয়। পরিপাককৃত খাদ্য মেসেন্টেরনের কোষীয় প্রাচীরের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে হিমোসিলে প্রবেশ করে সারা দেহে পরিবাহিত হয়। অজীর্ণ খাদ্যবস্তু কোলনের ভিতর দিয়ে মলাশয়ে পৌছার আগেই কোলনের প্রাচীর তা থেকে পানি, লবণ, অ্যামিনো এসিড ও অজৈব আয়ন শোষণ করে নেয়। পরে কঠিন অপাচ্য বস্তু মলরূপে পায়ু পথে বাইরে নির্গত হয় ।
আরও দেখুন...